শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ) –এর কাজ চিন্তাধারা
পবিত্র মক্কয় অবস্থানকালে পৃথিবীর বিভিন্ন মুসলিম-অমুসলিম রাষ্ট্রর ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উত্থান- পতনের খবরাখবরের আলোকে লব্ধ অভিজ্ঞতা ও আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানের সাহাযো শাহ ওয়ালিউল্লাহর নিকট এ বিষয়টি প্রতিভাত হয়ে উঠেছিল যে, জীবনাদশের অন্তনিহিত শক্তি ছাড়া কেবলমাত্র রাষ্টীয় ক্ষমতাই কোন জাতিকে বাচিয়ে রাখতে পারে না। অন্যথায় বহুশত বছর যাত দোর্দন্ড প্রতিাপে শাসনদন্ড পরিচালনা করার পরও মুসলিম মিল্লাতের এ দুরবস্থা কেন? তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, একমাত্র ইসলামের অন্তনিহিত শক্তির দ্বারাই মসলমানরা দুনিয়ার দিকে দিকে বিজয় পতাকা উড্ডীন করতে সমর্থ হয়েছে। কাজেই মুসলিম জাতির উপযোগী রাস্ট্রয় পরিকল্পনা পেশ করার সাথে সাথে ইসলামী শক্তির বাদের একটি যুক্তিযুক্ত ব্যাখাও মানুষের সামনে পেশ করা একান্ত প্রয়োজন। ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন গড়ে তুলতে পারলেই মুসলমানগণ তাদের গৌরবোজ্জল অতীতকে ফরে পাবে-লাভ করবে তার আদর্শ জীবন, আর এভাবেই জাতি হিসাবে বেঁচে থাকতে সমর্থ হবে। রাজতান্ত্রিক পরিবেশের প্রতিকূতার মধ্যে সৃষ্ট বিশেষ এক সকম সুফী ভাবধারার ক্রমবিকাশের ফলে মুসলিম জনগণের মধ্যে ইসলামের যে অসম্পূর্ণ রূপে ফুটে উঠেছিল, তার কারণে অধিকাংশের মধ্যেই এ ধারণা বদ্ধমুল হতে চলেছিল যে, রাষ্ট্রীয় ব্যাপার তথা রাজনীতি এ ধর্ম আলাদা জিনিস, ব্যক্তিগততভাবে ইসলামের আনুষ্ঠানিক কতিপয় বিধি-বিধান পালিত হলেই মানুষ পরকালে মুক্তি পাবি, আর রাজনীতি দুনিয়াদারির ব্যাপার, এটা দুনিয়াদারদের জর্নই শোভা পায় শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী এ দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি কঠোর আঘাত হেনেছেন। তাঁর মতে মানুষের পার্ধিব ও পারলৌকি উভয় জীবনের উন্নতি সাধনই নবুওতের মূল্য। তিনি বলেন, আমরা কুরআন মজীদে দেখতে পাই, যখন কোন জাতির নৈতিক অবনতি ঘটেছে তখনই তাদের মধ্যে নবী- রসূলের আগমন হয়েছে আর তাদের নির্দেশিত জীবন ব্যবস্থা অনুসারে চলার ফলে জাতির নৈতিক উন্নতির সাথে সাথে আর্থিক তথা জাগতিক উন্নতি সাধিত হয়েছে। তার মতে, দীনের দৃষ্টিতে আধ্যাত্মিক রাষ্ট্রীয় উন্নতিতে কোন তফাত নেই। জাতীয় উন্নতি বলতে নৈতিক এবং পার্থিব উন্নতি দু’ই বুঝতে হবে। মুসলমান জাতির ক্রমোন্নতির ইতহাসই তার সাক্ষ্য। এ জন্যই পবিত্র কুরআনের ভাষায় মুসলমানদের এ বলে মুনাজাত করতে বলা হয়েছে যে, ‘হে আমাদের প্রতপালক! তুমি আমাদেরকে দুনিয়া এ আখিরাতের কল্যণ দান করো।,
যা হোক মানব জীবনের সার্বিক উন্নতিকল্পে ইসলামকে জীবনের পরিপূর্ণ একটি বিজয়ী ও শক্তিশালী আদর্শ হিসাবে তুলে ধারা জন্য খৃস্টীয় অষ্টাদশ শতকের এ শ্রেষ্ঠ চিন্তনায়ক দার্শনিক হজ্ব থেকে ফিরে আসার পর নতুন পরিকল্পনা মাফিক ইসলাম সম্পর্কে যেসব অমর গ্রন্হ রচনা করে গেছেন, তন্মধ্যে তিনটি বিষয় লক্ষ করা যায় (১) সমালোচনা ও সংশোধনমূলক বিষয়, (২) গঠনমূলক বিষয় (৩) এসবের আলোকে গণসংগঠন। তবে যেহেতু পূর্বেই বলা হয়েছে, যে তৃতীয় বিষয়টির প্রতি হাত দেয়ার সময় তাঁর হয়ে উঠেনি, কিন্তু তাঁর রচনায় এদিক ইঙ্গিত রয়েছে। তাই তাঁর কাজ ও চিন্তাধারার প্রথম দু’টি বিষয় নিয়েই এখানে আলোচনার প্রয়াস পাবে।
শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ) মক্কা থেকে আগমনের পর নতুন পরিকল্পনা মাফিক যেসব সংস্কারমূলক কাজ করেন প্রধানত ঐগুলোকে দু’ভাগে বিভক্ত করা চলে (১) সমালোচনা ও সংশোধনমূলক এবং (২) গঠনমূলক। বিশেষজ্ঞদের মতে শাহ ওয়ালিউল্লাহই প্রথম ব্যাক্তি যাঁর দৃষ্টি ইসলামের ইতিহাস ও মুসলমানের ইতহাস- এ সূক্ষ্ণ ও মৌল পার্থক্য পযর্ন্ত পৌছেছে, যিনি ইসলামী ইতিহাসের দষ্টিভঙ্গি দিয়ে মুসলিম ইতিহাসের সমালোচনা ও পর্যালোচনা করেন এবং যিনি এ কথা অবগত হবার চেষ্ট করেন যে, বিভিন্ন শতকে ইসলাম গ্রহণকারী জাতিদের মধ্যে আসলে ইসলামের কি অবস্থা ছিল। এটা অত্যন্ত জটিল বিষয়বস্তু। অতীতেও এ ব্যাপারে কিছু লোক বিভ্রান্তির শিকার হন এবং আজও হচ্ছেন। এ ব্যাপারে ‘ইযালাতুল খিফা [ ১২৮৬ হিজরীতে বেরিলী থেকে প্রকাশিত সংস্করণ] গ্রন্হের ষষ্ঠ অধ্যায়ের ১২২ পৃষ্ঠা থেকে ১৫৮ পৃষ্ঠায় তিনি ধারাবাহিক ভাবে মুসলিম ইতহাস সম্পর্কে আলোচনা করেন। তিনি অত্যন্ত সাফল্যের সাথে প্রত্যেক যুগের বিশেষত্ব এবং উদ্ভুত ফিতনার বিবরণ দান প্রসঙ্গে এ সম্পর্কিত সুস্পষ্ট ইঙ্গিতবহ মহানবীর ভবিষ্যদ্বাণী সমূহ উব্ধত করেন। তাতে তিনি মোটামুটিভাবে মুসলমানদের আকীদা, বিশ্বাস শিক্ষা, সংস্কৃতি, নৈতিকতা ও রাজনীতি সংমিশ্রিত সকল প্রকার জাহিলিয়াতের দিকে অঙ্গুলি নিদের্শ করেন। অতপর যাবতীয় ক্রটির মধ্য থেকে যেগুলো মৌলিক এবং সকল ক্রটির উৎস, এমন দু’টির প্রতি অঙ্গুলি নিদের্শ করেন। এক নবুওত পদ্ধতির খিলাফত থেকে রাজতন্ত্রের দিকে রাজনৈতিক কর্র্তত্বের গতি পরিবর্তন। দুই, ইজতেহাদের প্রাণ শক্তির মৃত্যু ও মনে মস্তিষ্কর উপর অন্ধ অনুসারিতার আধিপত্য। প্রথমটির ব্যাপারে তিনি। বর্ণিত কিতাবে রাজতন্ত্রের নীতিগত ও পারিভাষিক পার্থক্যকে এমন সুস্পষ্টরূপে তুলে ধরেন এবং হাদীসের সাহায্যে তার এমন যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা প্রধান করেন যে, তাঁর পূর্বেকার লেখকদের রচনায় তার দৃষ্টান্ত বিরল। এমনিভাবে ইসলামী বিপ্লবের ফলাফলকে তিনি যেরূপ পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করেছেন, পূর্ববর্তীদের রচনায় তেমনটি দেখা যায় না। এক স্থানে তিনি লেখেনঃ “ইসলামের মূল স্তম্ভগুলো প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে বিরাট ক্রটি পরিলক্ষিত হয়েছে। হযরত উসমান (রা) এর পর কোন শাসক হ্জ্ব কায়েম করা ইসলামে অপরিহার্য বিষয়গুলোর অন্তর্ভুক্ত। কেননা, সিংহাসনে আরোহণ করা, রাজমুকুট পরিধান করা এবং অতীত রাজা- বাদশাহদের আসনে বসা যেমন কায়সার ও কিসরার জন্য রাত্বের প্রতীকরূপে পরিগণিত হতো, তদ্রপ নিজের কর্তৃকত্ব হজ্ব প্রতিষ্ঠ করা ইসলামে খিলাফতের প্রতীক হিসাবে পরিচিত।“ ( ইযালাতুল খিফা- ১ম খন্ড, ১২৩- ১২৪ পৃষ্ঠা)
অতপর তিনি ‘ইযালা’ গ্রন্হের ১৫৭ পৃষ্ঠায় বলেনঃ “এদের সরকার অগ্নিপুজকদের সরকারের ন্যায়। শুধু পার্থক্য এ জায়গায় যে, এরা নামায় পড়ে এবং মুখে কলেমায়ে শাহাদত উচ্চরণ করে। এ পরিবর্তনের মধ্যে আমাদের জন্ম। জানি না, পরবর্তীকালে আল্লাহ আরও বা কতকিছু দেখান। এ ব্যাপারে “ হজ্জাতুল্লাহিল বালিগা”‘বদুরে বাজেগাহ “তাফহীমাত’“মুসফফা’ ও তাঁর অন্যান্য গ্রন্হ আলোচনা রয়েছে।
দ্বিতীয় ক্রটি অর্থাৎ কোন ব্যাপারে নিরপক্ষ এ মুক্ত চিন্তা নিয়ে কুরআন ও সুন্নহর সঠিক অনুশাসন বা তার অনুকূলে বিধানের খোঁজ না নিয়ে অন্ধভাবে অপরের অনুসরণ করা। এ ব্যাপারে শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ) আলোচ্য গ্রন্হের ১৫৭ পৃষ্ঠা বলেনঃ
সিরীয় শাসকদের ( উমাইয়া সরকার) পতনকাল পর্যন্ত কেই নিজেকে হানাফী বা শাফেয়ী বলে দাবী করতো না। বরং সবাই নিজেরদর ইমাম ও শিক্ষকগণের পদ্ধতিতে শরীয়তের প্রমাণ সংগ্রহ করতেন। ইরাকী শাসকদের ( আব্বাসীয় ) আমলে প্রত্যেকেই নিজের জন্য আলাদা নাম নির্দিষ্ট কের নেয়া। তাদের অবস্থা এ পর্যয়ে গিয়ে উপনীত হয় যে, নিজ নিজ মাযহাবের নেতাদেরর সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত না পাওয়া পর্যন্ত কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে তারা কোন কিছুর সিদ্ধান্ত করতো না। এভাবে কুরআন ও সুন্নহার ব্যাপারে ব্যাপারে অনিবার্যরূপে যেসব মতবৈষম্যের উদ্ভব হয়েছিল, সেগুলো স্থায়ী বুনিয়াদের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। অতপর আরব শাসকদের পর যখন তুর্কী শাসনামলে মানুষ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে, তখন প্রত্যেকেই ফিকাহ ভিত্তিক মাযহাব থেকে ছড়িয়ে পড়ে, তখন প্রত্যেকেই ফিকহ ভিত্তিক মাযহাব থেকে যা কিছু স্মরণ করতে সক্ষম হয় ঐ টুকুকেই নিজেদের আসল দীনে পরিণত কর। পূর্বে যে সকল বস্তু কুরআন ও হাদীসের সূত্র উদ্ভূত মাযহাব ছিল, তখন তা স্থায়ী সন্নহতে পরিণত হয়েছে।‘ তিনি ‘মসফফা গ্রন্হের ১ম খন্ডের ১১ পৃষ্ঠায় লেখেনঃ আমাদের যুগের সরল লোকেরা ইজতিহাদ থেকে বিমূখ। এদের নামে। তাদের ব্যাপার্ই আলাদা। ঐসব ব্যাপার বুঝার যোগ্যই নয়। শুধু অন্ধনুসরণ না করে স্বাধীন ও মুক্ত বিচারবুদ্ধি নিয়ে কুরআন-সান্নাহ থেকে সমস্যার মসধান খোঁজ করা সম্পর্কে “হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা”র সপ্তম অধ্যায়ে ও “আল-ইনসাফ” গ্রন্হে শাহ ওয়ালিউল্লাহ বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। অন্ধনুসরণের ও ব্যাধির পূর্ণ ইতিহাসে তাতে বিবৃত হয়েছে এবং এর দ্বারা সৃষ্ট যাবতীয় ক্রটির প্রতি তিনি অঙ্গুলি নিমের্শ করেছেন, যা পরে বিবৃত হচ্ছে।
সমসাময়িক পরিস্থিতির পর্যালোচনা
সমালোচনার উপরিউক্ত গুরুত্বপূর্ণ দু’টি বিষয়ের উদ্ধুতির পর সংক্ষেপে তাঁর সমকালীন পরিস্তিতি সম্পর্কিত সমালোচনামূলক কয়েকটি উদ্ধুতি নিম্নে প্রদত্ত হচ্ছেঃ
১. সূফীবাদের একটি ত্রুটির সমালোচনা
“অনুভূতির পূজা সুফীদের জনপ্রিয়তা এ তাদের ভক্তদলে শামিল হাবার কারণে এর উদ্ভব হয়েছে। মাশরিক ও মাগরিবের সমগ্র এলাকায় এ জিনিসটি ছেয়ে আছে। এমনকি সুফীদের কথা ও কর্ম সাধারণ মানুষের মনের উপর কুরআন ও সুন্নাহ তথা সবকিছুর চাইতে অধিক আধিপত্যশালী। তাদের তত্ত্বকথা ও ইঙ্গিতসমূহ এত বেশী প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে যে, কেই এগুলোকে অস্বীকার কিংবা এর প্রতি আমল না দিলে সে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারে না এবং ‘নেককার’ ও মুত্তাকীদের মধ্যে গণ্য হয় না। মিম্বরের উপর দাড়িয়েঁ এমন কোন ব্যক্তি নেই যে, সুফীদের ইশারা-ইঙ্গিত সম্বলিত বক্তুতা করে না। মাদ্রাসায় অধ্যাপনারত এমন কোন আলিমও নেই, যে তাদের কথায় বিশ্বাস ও দৃঢ় প্রত্যয় পোষণ না করে। অন্যথায় তারা নির্বোধ বিবেচিত হয়।
২. অযোগ্য পীর ও পীরজাদাদের কঠোর সমলোচনা
‘কোন যোগ্যতা ছাড়াই যেসব পীরজাদা বাপ-দাদার গদীনশীন হয়েছে, তাদেরকে আমি বলিঃ ‘তোমরা কেন এসব পৃথক পৃথক দল গঠন করে রেখেছো? তোমাদেরকে প্রত্যকেই নিজের নিজের পথে ( তরীকা) চলেছো কেন? আল্লাহতায়ালা মুহাম্মদ (সা) কে যে পথে বাতলিয়ে দিয়েছেন সেটি পরিত্যাগ করেছো কেন? তোমাদের প্রত্যেক এক একজন ইমামে পরিণত হয়েছে। মানুষকে নিজেদের দিকে আহ্বান জানাচ্ছে। নিজেদেরকেই হিদায়াতদানকারী ও হিদায়াতকারী মনে করছে অথচ নিজেই মানুষকে পথভ্রষ্ট করছে। পর্থিব স্বার্থের গরজে যারা মানুষকে ‘বয়’আত’ করায় তাদের প্রতি আমরা বিন্দুমাত্রও সন্তুষ্ঠ নই। আর যারা দুনিয়ার স্বার্থে ইলম হাসিল করে অথবা, মানুষকে নিজেদের দিকে আহ্বান করে, তাদের দ্বারা নিজেদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করে, তাদের প্রতিও আমরা সন্তুষ্ঠ নই। তারা সবাই দস্যু, দাজ্জাল, মিথ্যুক, প্রবঞ্চক ও প্রবঞ্চিত। (তাফহীমাত)।
বস্তুত এ কারণেই কেউ বলে যে, তাসাউফের বিরুদ্ধে ভারতে সর্বপ্রথম শাহ্ ওয়ালিউল্লাহই বিদ্রোহের বাণী উচ্চারণ করেছেন। অথচ প্রকৃত ব্যাপার তার বিপরীত। আসলে তিনি ইসলামের খাৎটি তাসাউফ যাকে কুরআনের ভাষায় ‘তাযকিয়ায়ে নাফস’ বলা হয়েছে তাকে বহিরাগত আবর্জনা মুক্ত করেছেন এবং ইসলামের দৃষ্টিতে যা নির্ভেজাল তাসাউফ তিনি তাই পেশ করেছেন। বলা বাহুল্য, শাহ ওয়ালিউল্লাহ যদি তথাকথিত তাসাউফের এরূপ সমালোচনা ও তার সঠিক রূপরেখা তুলে না ধরতেন, তাহলে পাশ্চাত্য লেখকরা যেভাবে একে “বিভিন্ন দেশ ও ধর্ম এমনকি ভারতীয় যোগীদের ভাবধারা থেকে ধার করা” পর্যন্ত বলে হালকা করার প্রয়াস পাচ্ছিল, তার ফলে আজ তার অস্তিত্ব থাকতো কিনা সন্দোহ।
৩. শিক্ষা পদ্ধতির ক্রটির প্রতি নির্দেশ
“নিজেদেরকে ওলামা (শিক্ষিত) আখ্যাদানকারী জ্ঞানার্জনকারীদের বলিঃ “নির্বোধের দল, তোমরা গ্রীকদের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মানতিক-বালাগত তথা ন্যায়শাস্ত্র ও অলংকাল শাস্ত্রের গোলক ধাঁধাঁয় আটকে পড়েছো। আর ধরে নিয়েছো যে, জ্ঞান কেবল এগুলোতেই আছে। অথচ সত্যিকার বিদ্যা আল্লাহর কিতাবের সুস্পষ্ট আয়াতে এবং তাঁর রসূলের মাধ্যমে প্রমাণিত সুন্নাতের মধ্যে নিহিত। তোমরা পূর্ববর্তী ফকীহগণের খুটিঁনাটি ও বিস্তারিত বর্ণনাবলীতে ডুবে গিয়েছো। তোমরা কি জান না যে, আল্লাহ এবং তাঁর রসূল যা বলেছেন সেটিই একমাত্র হুকুম। তোমাদের বেশিরভাগ লোকের অবস্থা হচ্ছে এই যে, নবীর কোন হাদীস যখন তাদের নিকট পৌছে তখন তারা তার উপর আমল করে না।“
আলিম সমাজের প্রতি লক্ষ্য করে তিনি বলেছেনঃ “তোমরা আল্লাহর বান্দাদের জীবনের পরিধি সংকীর্ণ করে দিয়েছো। ইসলামের নমনীয়তাকে তোমরা উপেক্ষা করছো।“
৪. কুরআন-হাদীসের শিক্ষার প্রত গুরুত্ব আরোপ
ইমাম শাহ ওয়ালিউল্লাহর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, কুরআন ও সুন্নাহর প্রকৃত শিক্ষার ব্যাপক প্রচারের উপরই জাতির উন্নতি সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল। এ জন্য তিনি এ দিকে বিশেষ মনোযোগ দান করেন এবং তদানীন্তন রাষ্ট্রভাষা ফার্সীতে কুরআন মজীদ ও ‘মুয়াত্তা-ই-ইমাম মালিক’- এর তরজমা করেন। অবশ্য পরবর্তীকালে উর্দু ভাষায় কুরআন মজীদের তরজমা ও তফসীর করেন।
কুরআন মজীদ অধ্যয়েনের পর যাতে হাদীসের জ্ঞান লাভ করা যায় তিনি তদ্রুপ শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। একমাত্র শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ্ এবং তাঁর পুত্র ও তাদেঁর শাগরিদদের প্রচেষ্টায়ই উপমহাদেশে ‘ইলমে হাদীসের ব্যাপক প্রসার ঘটে।
মিসরের প্রসিদ্ধ শিক্ষাবিদ, আল্লমা রশীদ রেযা এ সম্পর্কে বলেনঃ “মিসর, সিরিয়া, ইরাক, হিজায প্রভৃতি দেশে হিজরী দশম শতক থেকেই ‘ইলমে হাদীসে’র প্রচার হ্রাস পেতে থাকে। অথচ আমাদের ভারতীয় ভাইগণ বহু পরিশ্রমে উক্ত ইলেমকে জিন্দা রেখেছেন।“
৫. ইমাম সাহেবের প্রতি রক্ষণশীল ধর্ম ব্যবসায়ীদের হামলা
সত্যের ধারকরা যুগে যুগেই স্বার্থপর কিংবা রক্ষণশীলদের নির্যাতনের শিক্ষার হয়েছেন। ইমাম শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভীও এ থেকে রেহাই পাননি। এক শ্রেণীর মতলববাজ ধর্ম ব্যবসায়ী আলিম ও পীর ভবিষ্যতে নিজেদের স্বার্থ নষ্ট হবার আশংখায় ইমাম সাহেব কর্তৃক কুরআন তরজমা করণের প্রশ্নটিকে কেন্দ্র করে সাধারণ মুসলমানদেরকে তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলে। তারা চিরাচরিত্র কায়দায় তাঁর বিরুদ্ধে ফতোয়াবাজিতে লিপ্ত হয়। এমনকি, একবার তিনি ফতেহপুর মসজিদে অবস্থানকালে এই গোঁড়া প্রকৃতির ধর্মব্যবসায়ীরা দলবদ্ধভাবে তাঁর উপর সশস্ত্র হামলা চালায়। ঐ সময় তাঁর নিকট শুধু একটি কাঠের টুকরা ছিল। তিনি তা হাতে নিয়ে ‘আল্লাহ আকবর’ ধ্বনি উচ্চারণ করে সকলকে স্তব্ধ করে দেন এবং তাদের মধ্য দিয়েই নিরাপদে স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করতে সক্ষম হন।
৬. শাসকদের প্রতি
-তোমরা আরাম আয়েশে লিপ্ত হয়ে সাধারণ গণমানুষকে পরস্পর সংগ্রামে লিপ্ত হবার সুযোগ দিচ্ছো। প্রকাশ্যে শরাব পান চলছে অথচ তোমরা বাধা দিচ্ছো না। প্রকাশ্যে ব্যভিচার, জুয়া ও শরাবের আড্ডা চালু হচ্ছে অথচ তোমরা এগুলো বন্ধ করো না। এ বিরাট দেশে কাউকে শরীয়তের আইন অনুযায়ী শাস্তি দেয়া হয়নি। তোমরা যাকে দুর্বল মনে করো তাকে খেয়ে ফেলো, যাকে শক্তিশাল মনে করো, তাকে ছেড়ে দাও। নানা রকম খাদ্যের স্বাদ গ্রহণ, স্ত্রীদের মান অভিমান এবং গৃহ-বস্ত্রের বিলাসিতার মধ্যেই তোমরা ডুবে গিয়েছো। একবার আল্লাহকে ভয় করো। তোমরা আমীর-ওমরাহরা নিজেদের কর্তব্য সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছো। যাদের রক্ষণাবেক্ষণের ভার তোমাদের উপর ন্যস্ত ছিল, তোমরা সেই জনগণের অবস্থার প্রতি মোটেই দৃষ্টি দিচ্ছো না। দায়িত্বহীনতার ফলে (সমাজের) এক শ্রেণীর লোক অপর শ্রেণীর উপর বেপরোয়া জুলুম চালিয়ে যাচ্ছে’’
৭. জিহাদের জন্য আহ্বান ও তার মূল লক্ষ্যের প্রতি নির্দেশ
“বর্তমান অবস্থায় মুসলিম রাষ্ট্র প্রধানদের পক্ষে শান্তি ও ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠাকল্পে আপোষহীন মনোবল নিয়ে আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী জিহাদে ঝাপিয়েঁ পড়া দরকার। অত্যচারীরা পরাজিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত রাখা কর্তব্য। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম সফল হবার পর তাদের কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ হবেন এবং সাধ্য মতো সংগ্রাম করে দুনিয়ায় আল্লাহর বিধান প্রতিস্ঠা করবেন, তখনই দেশের দিকে দিকে দেখা দিবে প্রকৃত শান্তি। তার ফলেই আমাদের জীবন হবে আনন্দমুখর ও সাফল্যমন্ডিত।“
৮. সৈনিকদের উদ্দেশ্য
“আল্লাহ তোমাদের জিহাদ করার জন্যে, সত্যের সুমহান বাণীকে বুলন্দ করার উদ্দেশ্যে এবং শিরক ও মুশরিকদের শক্তি খতম করার জন্য সৈনিকে পরিণত করেছেন। তোমরা ঐ কর্তব্যকে অবহেলা করে নিছক ঘোড়সওয়ারী ও অস্ত্রশজ্জা করাকেই নিজেদের পেশায় পরিণত করেছো। অর্থোপার্জন করার জন্যে তোমরা সেনাবাহিনীতে চাকরি নিয়েছো।“
৯. শ্রমজীবী ও সাধারণ মানুষের নৈতিক অবস্থার সমালোচনা
“বিশ্বস্ততা ও আমানতদারী তোমাদের নিকট থেকে বিদায় নিয়েছে। প্রতিপালক থেকে গাফিল এবং এ সংঙ্গে শিরকে লিপ্ত রয়েছো। তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি অবস্থা কিছুটা স্বচ্ছল সে নিজের খানাপিনা ও পরিচ্ছদে বেশী খরচ করে। ব্যয় অনুপাতে আয়ের পরিমাণ কম হওয়ায় অপরের অধিকার নষ্ট করে।“
১০. আলিম সমাজের প্রতি
“তোমরা আল্লাহর বান্দাদের জীবনের পরিধি সংকীর্ণ করে দিয়েছো। তোমরা ব্যাপকতার জন্যে আদিষ্ট –সংকীর্ণতার জন্য নয়।“
এভাবে তিনি মুসলিম সমাজে প্রচলিত অনেক কুসংস্কার ও ইসলামের সঙ্গে সম্পর্কশূন্য বহু রীতি-নীতিরও কঠোর সমালোচনা করেছেন। বিশেষ করে মনস্কামনা পূর্ণ করার উদ্দেশ্যে যারা পরলোকগত বুযুর্গের দরবারে গিয়ে তার নিকট কিছু চায়, তারা ব্যাভিচারের চাইতে বড় অপরাধে অপরাধী বলে উল্লেখ করেছেন। এই উদ্ধৃতিগুলো থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে, তিনি কত গভীরভাবে মুসলমানদের অতীত ও বর্তমানকে পর্যালোচনা করেছেন।
গঠনমূলক কাজ
গঠনমূলক কাজের মধ্যে তাঁর প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কাজটি হলো, তিনি ফিকাহ্ তথা ইসলামী আইনশাস্ত্রে একটি যুক্তিপূর্ণ মধ্যপন্থা পেশ করেন। এতে সাধারণ রীতি অনুযায়ী একটি বিশেষ মতের প্রতি পক্ষপাতিত্ব ও অন্য একটি মতের সমালোচনা করা হয়নি। একজন গভীর অনুসন্ধানকারীর ন্যায় তিনি সকল ফিকাহ্ ভিত্তিক মাযহাবের নীতি-পদ্ধতি অধ্যয়ন করেন এবং পূর্ণ স্বাধীনভাবে রায় প্রদান করেন। শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ্ মাযহাবী বিরোধের প্রবণতা হ্রাস এবং মাযহাব অনুসারীদের মধ্যে অনুসন্ধান ও ইজতিহাদের পথ উন্মুক্ত করেন। তিনি সকল মাযহাবের মধ্যে সমঝোতা, বিশেষ করে শাফেয়ী ও হানাফী মাযহাবদ্বয়কে একটি মাযহাবের রূপ দিতে প্রয়াসী ছিলেন। ‘তাফহীমাত’ এবং ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগা’ ও ‘আল ইনসাফ’-এ এ ব্যাপারে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। বস্তুত এই মধ্যপ্রন্থা গ্রহণ করার ফলে বিদ্বেষ, সংকীর্ণতা, অন্ধ অনুসৃতি ও অনর্থক দীর্ঘ আলোচনায় সময় ক্ষেপণের অবসান ঘটে। আর এরই মাধ্যমে নানা মতের মুসলিমদের একটি গতিশীল জীবন্ত জাতি হিসেবে বিশ্বে দাঁড়ানো সম্ভব। এ জন্যেই শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ্ ইজতিহাদের প্রয়োজনের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
ইজতিহাদ
‘মুসাফফা’ গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি ইজতিহাদের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলেনঃ “ইজতিহাদ প্রতিযুগে ‘ফরযে কিফায়া’। এখানে ইজিতহাদ অর্থ হলো শরীয়তের বিধানাবল সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞানার্জন এবং সেগুলোর বিস্তারিত ও খুটিনাটি বিষয়ের ব্যাখ্যা অনুধাবন করে শরীয়তের আইন-কানূনকে যথাযথভাবে সংযোজন ও সংগঠন করা, তা কোন বিশেষ মাযহাব প্রণেতার অনুসারীও হতে পারে। আর ইজতিহাদ প্রতি যুগে ‘ফরযে কিফায়া’ হবার যে কথা বলছি তা এ জন্যে যে, প্রতি যুগে অসংখ্য স্বতন্ত্র সমস্যার সৃষ্টি হয়। সেগুলো সম্পর্কে আল্লাহর নির্দেশ জানা ওয়াজিব হয়ে পড়ে। আর ইতিপূর্বে যেসব বিষয় লিপিবদ্ধ ও সংকলিত হয়েছে। তা এ ব্যাপারে যথেষ্ট হয় না বরং তার মধ্যে নানান মতবিরোধও থাকে। শরীয়তের মৌল বিধানের প্রতি প্রত্যাবর্তন না করলে এ মত বিরোধ দূর করা সম্ভব হয় না। এ ব্যাপারে মুজতাহিদগণ যে পদ্ধতি নির্ধারণ করেছিলেন, তাও মাঝপথে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে। কাজেই এ ক্ষেত্রে ইজতিহাদ ছাড়া গত্যন্তর নেই।“
শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ (রহ) ইজতিহাদের উপর কেবল জোরই দেননি, বরং বিস্তারিতভাবে ইজতিহাদের নিয়ম-রীতি, সংবিধান ও শর্তাবলীও বর্ণনা করেছেন। ‘ইযালাতুল খিফা’‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’, ‘ইকদুল জীদ’, ‘আল ইনসাফ’, ‘বদুরে বাযেগা’, ‘মুসাফফা’ প্রভৃতি গ্রন্থে কোথাও তার নিছক ইঙ্গিত এবং কোথাও বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। তার গ্রন্থ পাঠে মানুষ ইজতিহাদের কেবল রীতি নিয়মই শিখতে পারে না, এ বিষয়ে শিক্ষা লাভও করতে পারে।
উল্লেখিত কাজ দু’টি শাহ্ ওয়ালিউল্লাহর পূর্ববর্তী লোকেরাও করেছেন। কিন্তু যে কাজ তাঁর পূর্বে আর কেউ করেননি তা হলো এই যে, তিনি ইসলামের সমগ্র চিন্তা, নৈতিক সাংস্কৃতিক ও শরীয়ত ব্যবস্থাকে লিপিবদ্ধ আকারে পেশ করার চেস্টা করেছেন। এ কাজের ব্যাপারে তিনি তাঁর পূর্ববর্তীদের ছাড়িয়ে গেছেন। যদিও প্রথম তিন চার শতকে অনেক বেশী ইমামের আবির্ভাব হয়েছে এবং তাদেঁর কার্যাবলী পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট দেখা যায় যে, তাদেঁর কার্যাবলী পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট দেখা যায় যে, তাদেঁর চিন্তারাজ্যে ইসলামের জীবন ব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ চিত্র ছিল এবং অনুরূপভাবে পরবর্তী শতাব্দীগুলোতেও এমন অনেক অনুসন্ধানকারী গবেষকের সাক্ষাত পাওয়া যায়, যাদেঁর সম্পর্কে ধারণা করা যায় না যে, তাদেঁর চিন্তা রাজ্যও এ চিন্তা শূন্য ছিল। তবু তাদেঁর একজনও সুনিয়ন্ত্রিত ও যুক্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে ইসলামী ব্যবস্থাকে একটি জীবন ব্যবস্থা হিসাবে লিপিবদ্ধ করার দিকে দৃষ্টি দেননি।
তিনিই ইসলামী দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইতিহাসে তিনিই প্রথম ব্যক্তি, যাকেঁ ইসলামী দর্শন লিপিবদ্ধকরণের ভিত্তি বলেছেন ও লিখেছেন, লোকেরা তাকে ভ্রান্তিবশত ইসলামী দর্শন নামে আখ্যায়িত করেছে। অথচ সেগুলো ছিল মুসলিম দর্শন। ঐ সব দর্শনের বংশসূত্র গ্রীস, রোম, ইরান ও হিন্দুস্তানের সাথে সম্পর্কিত। যদিও শাহ্ সাহেবের পরিভাষার ক্ষেত্রে পুরাতন দর্শন, কালাম শাস্ত্র কিংবা সেখানকার বহু চিন্তা ও ধারণা লক্ষ্য করা যায়, তা শুরুতে নতুন পথ আবিস্কারদের জন্য স্বভাবতই অপরিহার্য হয়ে পড়ে।
শাহ ওয়ালিউল্লাহর সমাজ দর্শন
তিনি বিশ্ব জাহান ও এর মানুষ সম্পর্কে এমন এক দর্শন সৃষ্টি চেষ্টা, করেছেন, যা ইসলামের নৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল ও তার সমভাবাপন্ন প্রকৃতিক অধিকারী হতে পারে।
নৈতিক ব্যবস্থা উপর তিনি একটি সমাজ দর্শনের (Social Philosophy) ইমারত নির্মাণ করেন। ইরতিফাকাত (মানুষের দৈনন্দিন সংগঠন, সামাজিক রীতিনীতি, রাজনীতি, বিচার ব্যবস্থা, কর-ব্যবস্থা (Taxation), দেশ শাসন, সামরিক সংগঠন প্রভৃতি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেন। এ সঙ্গে সমাজ সভ্যতার বিপর্যয় ও বিকৃতি সৃষ্টির কারণসমূহের উপর আলোকপাত করেন। তারপর তিনি শরীয়ত, ইবাদত, আহকাম ও আইন কানূনের পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা পেশ করেন এবং প্রত্যেকটি জিনিসের গুঢ় তথ্য বুঝাতে থাকেন। ইমাম গাযযালীকেও তিনি এ ব্যাপারে ছাড়িয়ে গেছেন। শেষের দিকে তিনি বিভিন্ন জাতির ইতহাস ও আইন-কানুনের প্রতি দৃষ্টি নিবন্ধ করেন।
উপরিউক্ত বিষয়গুলোর মধ্যে এখানে শুধু তাঁর দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর আলোকপাত করা হচ্ছে। একটি অর্থনৈতিক, অপরটি রাজনৈতিক।
অর্থনৈতিক চিন্তাধারা
ইমাম শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ অর্থনৈতিক দর্শনের মূলকথা হলো দেশের সামগ্রিক সম্পদ যে জনগোষ্ঠীর যৌথ বা বিক্ষিপ্ত প্রচেষ্টায় উৎপন্ন হয়ে থাকে, তাতে এমন সুষম বন্টন বা বিকেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থা থাকতে হবে, যাতে সম্পদ কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিশেষের হাতে পুঞ্জিভূত না হয়ে পড়ে। একচেটিয়া মালিকানা কিংবা দৈহিক বা মানসিক কোনরূপ শ্রমবিহীন মালিকানার তিনি বিরোধী। তাঁর মতে, নাগরিকত্বের প্রাণসত্তা হচ্ছে পারস্পরিক সহযোগিতা, আর এই সহযোগিতা সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে থাকে একের প্রতি অপরের কল্যাণকারিতার উপর, যা একমাত্র শ্রমের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। উল্লেখ্য যে, তিনি পুজিঁ ও মানসিক প্রচেস্ঠাকেও শ্রমের মধ্যে গণ্য করেন। অতএব তাঁর মতে, সমাজে কোন ব্যক্তি বিনাশ্রমে সম্পদ ভোগ করতে কিংবা অল্প শ্রমে অধিক সম্পদের অধিকারী হতে পারে না। কেননা, তাদের মধ্যে নারিকত্বের এই মূল শর্ত অনুপস্থিত থাকা সত্ত্বেও যদি তারা সম্পদের অধিকারী হয়, তা হলে স্মপদের যারা মূল উপার্জন শক্তি তথা কৃষক, শ্রমিক, পুজিঁ ও মানসিক শ্রমদাতা, তাদের অধিকার ক্ষুণ্ন হবে। আর তার অবশ্যন্তাবী পরিণতি হিসাবে সমাজে একদিকে শোষিত ও বঞ্চিতের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে, তাদের উপর নাগরিক দায়িত্বভার বেড়ে যাবে, তারা করভারে জর্জরিত হবে, অনাদায়ে নির্যাতন ও কঠোরতার সম্মুখীন হবে, অপরদিকে আর এক শ্রেণী কর্তৃক বিলাসিতা, বাহুল্য ও ইন্দ্রীয়পূজার বাজার গরম হয়ে উঠবে, যাতে কোন অবস্থায়ই জাতীয সম্পদ তো বৃদ্ধি পাবে না, পরন্তু তা অনেকের পকেটশূন্য হয়ে এক স্থানে এসে কুক্ষিগত হবে।
এক কথায়, তাঁর চিন্তাধারা অনুযায়ী চাষী-মজুর এবং অন্যভাবে শ্রমদাতা যেসব ব্যক্তি দেশ ও জাতির জন্য চিন্তামূরক কাজে নিয়োজিত, তারাই সম্পদের আসল অধিকারী (অবশ্য অক্ষম ও বিকলাঙ্গের কথা স্বতন্ত্র)। উপরিউক্ত ব্যক্তিদের উন্নতি ও সমৃদ্ধিই মূলত জাতির উন্নতি ও সমৃদ্ধি। এ শক্তিসমূহকে দাবিয়ে রাখার জন্য যে কোন ব্যবস্থা (চাই সেটা রাজতন্ত্রমূলকই হোক কিংবা অন্য কোন প্রকারের) সচেষ্ট হয়ে উঠলে সেটা কোন দেশ ও জাতির জন্য অবশ্যই মারাত্মক। এহেন অশুভ শক্তিকে অবশ্যই খতম করা উচিত-(হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা)। যে সমাজ ব্যবস্থা শ্রমের প্রকৃত মূল্য দেয় না তার অবসান হওয়া আবশ্যক- (হুজ্জাতুল্লাহিল বারিগা, সিয়াসাতুল মাদানীয়া অধ্যায়)। তাঁর মতে, অভাবী শ্রমিকের সম্মতিকে তার সন্তুষ্ঠি মনে করা চলে না, যে পর্যন্ত না তার ন্যায্য পারিশ্রমিক আদায় করা হবে, যা পারস্পরিক সহযোগিতার মূল নীতির ভিত্তিতে অপরিহার্য বলে গণ্য;(হুজ্জাত)। শ্রমিকের কাজের সময়কাল নির্দিষ্ট থাকতে হবে। তাকে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক সংশোধন এবং পরকালের ধ্যান ও চিন্তাভাবনার জন্য অবশ্যই অতিরিক্ত সুযোগ দিতে হবে। জনগণের উপর অধিক করের বোঝা চাপানো অন্যায়-(হুজ্জাত)। ব্যবসায়-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর একচেটিয়া অধিকার বা প্রভাব দেশের জন্য মারাত্মক-(হজ্জাত)। কোন রাজকীয় জীবন ব্যবস্থার অধীনে-যেখানে বিশেষ গোষ্ঠী বা পরিবারের অমিতব্যয়িতা, বিলাসিতা, খামখেয়াল ও ব্যয়-বাহুল্যের ফলে সমাজে সম্পদ বিকেন্দ্রীকরণের পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়, সে ক্ষেত্রে সাধারণ নাগরিকের দুঃখ মোচনার্থে উক্ত ব্যবস্থার অবসান হওয়া একান্ত জরুরী-(হুজ্জাত)।
এ থেকে এটাও স্পষ্ট হয়ে যায় যে, তাঁর নিকট রাজতন্ত্রের অপকারিতাসমূহ সুস্পষ্ট ছিল এবং ইসলামী খিলাফত ব্যবস্থার মধ্যেই তিনি মানবতার মুক্তি লক্ষ্য করেছেন। প্রসঙ্গত এ কথা উল্লেখ করা যেতে পারে যে, আধুনিককালে যদিও এসব বিষয় অহরাত্র চর্চা হয়ে থাকে, কিন্তু তিনি যে যুগে বসে এ কথা বলে গেছেন, সে সময়কাল পরিবেশ চিন্তু করলে সত্যি বিস্মিত হতে হয়। কেননা, তখনও ফরাসী বিপ্লব সংঘটিত হতে অর্ধশতক বাকী। কম্যুনিজমের জনক কার্লমার্ক্স ও তাঁর সহযোগী এঙ্গেলস-এর জন্মেরও এক শতক পরে। তখন ইউরোপের যান্ত্রিকযুগের বয়স মাত্র চল্লিশ বছর। তাই এ কথা নিসন্দেহে বলা চলে যে, শাহ্ ওয়ালিউল্লাহর মতো চিন্তাবিদ ও দার্শনিকের যে যুগে আবির্ভাব ঘটে, সে সময় যদি উপমহাদেশে যান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকাশ ঘটতো কিংবা তিনি কার্লমাক্স বা এঙ্গেলসের মতো কোন মুদ্রাযন্ত্রের দেশে জন্ম নিতেন-যেখান থেকে অল্প সময়ের মধ্যেই নিজের মতবাদ ও চিন্তাধারাকে দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে দেয়া যায়, তা হলে সম্ভবত সকলের পূর্বে তার সমাজদর্শন, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মতবাদই বিম্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করতো।
রাজনৈতিক চিন্তাধারা
এক. সার্বভৌমত্বের নিরংকুশ মালিক হচ্ছেন আল্লাহ তায়ালা। এতে কোনরূপ অংশীদারিত্ব সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ভূ-পৃষ্ঠে বিচরণকারী মানুষ হচ্ছে প্রবাসীর ন্যায়।
দুই. মানুষ হিসাবে প্রতিটি আদম সন্তানের সমান মর্যাদা। একের প্রতি অপরের প্রভুত্ব দাবী করার কোন অধিকার নেই-এক মানুষ আর এক মানুষের দাসত্ব করতে পারে না। কোন ব্যক্তি রাষ্ট্র বা জাতির মালিক হতে পারে না। কোন মানুষের পক্ষে ক্ষমতাশালী কোন শাসকের প্রতিও এরূপ ধারণা পোষণ করা অবৈধ।
তিন. রাষ্ট্র প্রধানের মর্যাদা ‘মুতাওয়াল্লী’র সমতুল্য। মুতাওয়াল্লী প্রয়োজনবোধ করলে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে সে পরিমাণই অর্থ গ্রহণ করতে পারবেন, যে পরিমাণ দ্বারা রাষ্ট্রের একজন সাধারণ নাগরিকের জীবন নির্বাহ হয়ে থাকে।
চার. রাষ্ট্রের সর্বস্তরে একমাত্র আল্লাহর দীনেরই প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত।
মৌলিক অধিকার
এ ব্যাপারে ‘হজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’, ‘আল বদুরুল বাযেগাহ্’, প্রভৃতি গ্রন্থে ‘ইরতিফাকাত’-জনকল্যাণ অধ্যায়ে যা বিশদরূপে বর্ণিত হয়েছে, তা হচ্ছেঃ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, বিবাহ, স্বাস্থ্য, সন্তান-সন্ততি, শিক্ষা-দীক্ষা লাভ প্রভৃতি জাতি-ধর্ম বর্ণ-ভাষা নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্মগত অধিকার। ঠিক অনুরূপভাবে উচু নীচু নির্বিশেষে ভেদ-বৈষম্যবিহীন রাষ্ট্রের সকল মানুষের প্রতি ন্যায় বিচার করা, তাদের জানমাল ও ইজ্জত-আবরুর হিফাজত করা, প্রতিটি নাগরিকের ব্যক্তি স্বাধীনতার সংরক্ষণ ও সমান নাগরিকত্বের অধিকার লাভ সকল জন্মগত অধিকারের অন্তর্ভূক্ত। তদ্রুপ প্রত্যেক সম্প্রদায়ের নিজ নিজ ভাষা ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের অধিকারও মৌলিক অধিকারসমূহের শামিল।
ইসলাম একটি বিপ্লবী দীন-একটি বিপ্লবী জীবন ব্যবস্থা
শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ ইসলামকে একটি বিপ্লবী জন বিধান বলেছেন। তাঁর মতে, ইসলাম যুক্তি ও শক্তিবাদের ধর্ম। বিশ্বমানবের মুক্তি ও কল্যাণের খাতিরে দুনিয়ার সকল মানুষকে একই আদর্শের পতাকা তলে সমবেত করার উদ্দেশ্যেই ইসলামের আবির্ভাব হয়। কুরআন মজীদের নির্দেশ অনুযায়ী যুক্তিবাদ ও সুষ্ঠু বুদ্ধিমত্তার পথেই মানুষকে ইসলামের পথে আহ্বান জানাতে হয়। শান্ত, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব ইসলামের মূল কথা। তবে ইসলামের আহ্বানে একান্তভাবে যুক্তিযুক্ত শান্তি প্রতিষ্ঠার খাতিরে হলেও প্রতিকূল পারিপার্শ্বিকতা, মিথ্যা, অহেতুক আভিজাত্যবোধ ও স্বার্থপরতা ইসরামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায় হতে পারে। এ জন্য শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ) বিশ্বাস করতেন যে, বৃহত্তর মানবগোষ্ঠীর কল্যাণের জন্য, এ সত্য ও শান্তির জবিন বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বব্যাপী বিপ্লবের সৃষ্টি হওয়া অসম্ভব নয়। যদি কখনও তদ্রুপ বিপ্লব দেখা দেয়, তবে তাকে সকল মানুষের সমর্থন করা উচিত মানব জাতির সার্বিক কল্যাণের খাতিরেই। তাঁর মতে, বৃহত্তম কল্যাণের খাতিরে ছোটখাট ক্ষয়-কস্থির কথা চিন্তা করা কখনও যুক্তিসঙ্গত নয়। কুরআন মজীদে উক্ত হয়েছে যে, “আল্লাহ পাক তাঁর রাসূলকে পথ নির্দেশমূলক হুকুম ও সঠিক জীবন বিধান দিয়ে একমাত্র এউদ্দেশ্যেই পাঠিয়েছেন যে, এটাকে (সঠিক জীবন বিধানকে) অন্যান্য সকল (মানব রচিত) জীবন বিধান ও বিধি-ব্যবস্থার উপর জয়যুক্ত করতে হবে-যদিও তাতে মুশরিক অবাধ্য লোকেরা জ্বলে পুড় উঠবে।“ এ আয়াতের মর্মানুযায়ী সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, ইসলাম মানুষের পথ নির্দেশ সত্য জীবন-বিধান হওয়া সত্ত্বেও তাকে দুনিয়ায় সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য একটি সুব্যবস্থার অবশ্যক। ইমাম শাহ্ ওয়ালিউল্লাহর মতে, এটা একমাত্র কোনো কেন্দ্রীয় শক্তির অধীন একটি ত্যাগী, একনিষ্ঠ, সুসংবদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ দলের মাধ্যমেই হওয়া সম্ভব। ভাড়াটিয়া বা পেশাদার কোন ফৌজ দ্বারা এরূপ কাজ সম্ভব নয়।
ওয়ালিউল্লাহ চিন্তাধারার ফসল
ইসলামী জীবন-ব্যবস্থা এহেন যুক্তিগ্রাহ্য ও সুসংগঠিত খসড়া পেশ হবার অর্থই হলো এই যে, তা সকল সুস্থ প্রকৃতি ও বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তির জীবনের লক্ষ্যে পরিণত হবে, আর তাদের মধ্যে যারা অধিকতর ক্ষমতার অধিকারী তারা এ লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে আসবে। শাহ্ সাহেব জাহেলী রাষ্ট্র ও ইসলামী রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যকে পরিস্কারভাবে তুলে ধরেই ক্ষান্ত হননি, এ ব্যাপারটাকে বার বার এমনভাবে বর্ণনা করেছেন, যাতে ঈমানদারদের পক্ষে জাহেলী রাষ্ট্র খতম করে সে স্থলে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রচেষ্ঠা না চালিয়ে নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’ ও ‘ইযালাতুল খিফা’তে এ বিষয়টির উপর সর্বাধিক জোর দেয়া হয়েছে। এ গ্রন্থটিতে তিনি হাদীসের সাহায্যে প্রমাণ করেন যে, ইসলামী খেলাফত ও রাজতন্ত্র দ্ইটি সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস অতপর একদিকে রাজতন্ত্র এবং সে সব বিপর্যয়কে স্থাপন করেন, যেগুলো ইতিহাসের বিভিন্ন যুগে রাজতন্ত্রের পথে মুসলমানদের সামষ্টিক জীবনে অনুপ্রবেশ করে এবং অন্যদিকে ইসলামী খিলাফতের বৈশিষ্ট্য ও শর্তাবলী এবং সে সব অবদান পেশ করেন, যা ইসলামী খিলাফত আমলে প্রকৃতপক্ষে মুসলমানদের মধ্যে অনুসৃত হয়। এরপরও মুসলমানদের পক্ষে নিশ্চিন্তে বসে থাকা কি করে সম্ভব হতে পারে? আর পারে না বলেই শাহ্ ওয়ালিউল্লাহর ইনতিকালের (১৭৮৬-১৮৩১) অর্ধশতক অতিক্রান্ত হবার আগেই ভরতবর্ষে সাইয়েদ আহমদ বেরেলবী ও ইসমাঈল শহীদ দেহলভীর নেতৃত্বে একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের উদ্ভব হয়। তারা একটি অস্থায়ী ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করেন। অবশ্য কতিপয় বৈষয়িক কারণে তা সাময়িকভাবে ব্যর্থ হলেও তার প্রভাব উপমহাদেশে এখনও বিদ্যমান। অবিভক্ত পাকিস্তান আন্দোলনের পশ্চাতে সেই আন্দোলনের প্রভাব কাজ করেছে এবং বলতে কী এ অঞ্চলে খাটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিস্ঠার যে আন্দোলন প্রকট, মূলত এটাও ওয়ালিউল্লাহর চিন্তাধারার ও বালাকোটে ইসলামী আন্দোলনের মুজাহিদদের চরম আত্মত্যাগেরই ফল। কেননা, বালাকোটের ব্যর্থতার পর যখন উপমহাদেশের মুসলমানদের উপর বিজাতীয় কর্তৃত্ব প্রাধান্য লাভ করে, তখনও আলিম সমাজ নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকেননি, তাঁরা ঘোর তমসার মধ্যেও ইসলামের নিভু নিভু দীপশিখা জ্বালিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। তাঁরা পরিকল্পনার মাধ্যমে উপমহাদেশে জালের ন্যায় দীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-মাদ্রাসা সমূহ কায়েম করে এগুলোর মাধ্যমে ইসলাম শিক্ষা-সঙস্কৃতিকে টিকিয়ে রেখেছেন। এ পরিকল্পনাধীন মাদ্রাসা সমূহের মধ্যে ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দই ছিল প্রধান। আযাদী ও ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্টিত দারুল উলুম দেওবন্দ ও এ জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে উপমহাদেশের মধ্যে ক্রমে ক্রমে যে ইসলামী জাগরণ মুসলমানদের মধ্যে সৃষ্টি হয়, পরবর্তী পর্যায়ে খিলাফত আন্দোলনের মধ্যে তারই অতিব্যক্তি ঘটে। তাই উপমহাদেশের মুসলিম জাগরণ ও পরবর্তীকালে পাকিস্তান আন্দোলন ও র্বমানে এদেশসহ সারা মুসলিম দুনিয়ায় যে ইসলামের নবজাগরণের পূর্বাভাষ লক্ষ্য করা যাচ্ছে এটাকে নির্দ্বিধায় ওয়ালিউল্লাহর চিন্তাধারা ও তাঁর বংশধর ও অনুসারীদের আন্দোলনেরই ফলশ্রতি বলতে হবে।
উল্লেখযোগ্য যে, শাহ্ ওয়ালিউল্লাহর আকাংখিত ইসলামী বিপ্লব সৃষ্টির উদ্দেশ্যে উপমহাদেশে প্রথম ইসলামী আন্দোলন (বালাকোট) এবং পরবর্তী পর্যাযে সিপাহী বিপ্লব, বাঙলাদেশে ফরায়েযী আন্দোলন, হাজী তিতুমীর মুন্সী মেহেরুল্লাহর আন্দোলন প্রভৃতি সকল জাতীয জাগরণের পটভূমি রচনায় যে মহাপ্রাণ ব্যক্তির মাধ্যমে শাহ সাহেবের চিন্তাধারা কাজ করেছিল তিনি ছিলেন তারই সুযোগ্য জেৌষ্ঠপুত্র শাহ্ আবদুল আযীয (রহ) (১৭৪৭-১৮২৪ খৃস্টাব্দ)। পিতার ইনতিকালের পর সমসাময়িক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে উক্ত মহান লক্ষ্যের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তিনি পিতৃ শিক্ষা প্রতিস্ঠানের (টীকা: উল্লেখযোগ্য যে, ইমাম সাহেব হজ্জ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর পুরাতন রহীমিয়া মাদ্রাসায় ছাত্র সংখ্যার আধিক্য হেতু সম্রাট মুহাম্মদ শাহ্ কর্তৃক মাদ্রাসার জন্য যে বিশাল অট্টালিকাটি প্রদত্ত হয়েছিলো সেটি ১৮৫৭ সালের হাঙ্গামায় ধ্বংস প্রপ্ত হয়) মাধ্যমে প্রথমে দীনী শিক্ষার ব্যাপক প্রচারের পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। আজকের উপমহাদেশে অগণিত ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্র রয়েছে। এগুলোর পত্যেকটি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উক্ত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কিত। শাহ্ আবদুল আযীযের মাধ্যমে অসংখ্য লোক বিপ্লবী বাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। তন্মধ্যে তাঁর চার ভ্রাতা, উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রদূত সাইয়েদ আহমদ শহীদ ও ইসমাঈল শহীদ দেহলভীসহ কতিপয় প্রখ্যাত শিষ্যের নাম নিম্নে প্রদত্ত হলোঃ (১) মওলানা শাহ্ রীফউদ্দিন, (২) মওলানা শাহ্ আবদুল কাদের, (৩) মওলানা শাহ্ আবদুর গনী, (৪) মওলানা শাহ্ মুহম্মদ ইসহাক, (৫) শাহ্ মুহাম্মদ ইয়াকুব, (৬) মওলানা শাহ্ মুহাম্মদ আবদুল হাই, (৭) মওলানা শাহ্ মুহাম্মদ ইসমাঈল, (৮) সাইয়েদ আহমদ শহীদ, (৯) মওলানা রশীদুদ্দীন, (১০) মওলানা মুফতী সদরুদ্দীন, (১১) মুফতী এলাহী বখশ, (১২) হযরত শাহ্ গোলাম আলী, (১৩) মওলানা মাখসুল্লাহ, (১৪) মওলানা করীমুল্লাহ, (১৫) মওলানা মীর মাহবুব আলী, (১৬) মওলানা আবদুল খালেক, (১৭) মওলানা হাসান আলী লক্ষৌভী, (১৮) মওলানা হোসাইন আহমদ মলীহাবাদী প্রমুখ।
শাহ্ আবদুল আযীয (রহ)-এর শিক্ষাদানের বিষয়বস্তুর মধ্যে ছিল-
(১) ইমাম শাহ্ ওয়ালিউল্লাহর চিন্তাধারাকে মন-মস্তিস্ক দিয়ে উপলব্ধি করা, (২) আল্লাহভীতি ও আদর্শ জীবন গঠনের প্রেরণা লাভ, (৩) রাজতন্ত্র ও সরকার তোষণ মনোভাব মন-মস্তিস্ক থেকে দূর করা, (৪) ইসলামী বিপ্লবকে পরিপূর্ণ জয়যুক্ত করণার্থে ত্যাগের স্পৃহা সৃষ্টি করা, (৫) সমাজসেবা ও দুঃস্থ মানবতার প্রতি সহানুভূতির উদ্রেক করা, (৬) রাজকীয় বিলাসিতা পরিহার করে সহজ-সরল জীবন-যাপন করা, (৭) জিহাদী ভাবধারা সৃষ্টি করা এবং যে কোন দুর্যোগ মুহুর্তে দৈর্য ও সহনশীলতার অনুশীলন করা, (৮) সমাজ বিধ্বংসী সকল প্রকার অনাচার, কুসংস্কার ও রীতিনীতি উৎখাতের চেষ্টা করা, (৯) বিলাসিতার আড্ডাখানাসমূহের অবসান করা, যা সমাজকে আরাম প্রিয় ও দুর্বল করে তোলে। এ ছাড়া শাহ্ আবদুল আযীয (রহ) রীতিমতো সপ্তাহে দুবার মুসলমানদের মধ্যে ইসলামী আদর্শ, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও উপরিউক্ত বিষয়সমূহের ব্যাপক প্রচারের উদ্দেশ্যে জনসভায় বক্তৃতা করতেন।
Comments